নিজস্ব প্রতিবেদক | সোমবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৩ | প্রিন্ট | 27 বার পঠিত
কবি আসাদ চৌধুরী, মানে শ্রদ্ধেয় কবি আসাদ ভাই নেই- খবর পেয়েছিলাম অফিসে বসেই। সংবাদপত্র অফিসে মৃত্যুর খবরগুলো শোক হওয়ার সুযোগ পায় না। কারণ, শোক যাদের ছড়াতে হয় তাদের শোক করার সময় কোথায়? কিন্তু আসাদ চৌধুরীর মৃত্যু আমার কাছে অত সহজ বিষয় নয়। আসাদ চৌধুরীর সাধারণ জীবনযাপন দেখে মনে হতো না কত বড় মাপের মানুষ ছিলেন তিনি। উর্দু ও ফার্সি ভাষা নিয়ে তার আগ্রহ ছিল অসীম।
কাঁধে ঝোলা, ঝাঁকড়া চুল। অনেক মসলা দিয়ে পান খাওয়ায় ঠোঁট থাকত লাল। আর সদাহাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী ছাড়া তাকে ভাবা যায়? চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি- ঢাকা শহরে কবি, বাংলাদেশে মাটির মানুষের কবি আসাদ চৌধুরী হেঁটে যাচ্ছেন। নিরাবেগ বোঝাপড়া নিয়ে হাঁটছেন। সেই ঢিলেঢালা রঙিন শার্ট বা পাঞ্জাবি পরা প্রেম, দ্রোহ ও প্রতিবাদের কবি আসাদ চৌধুরী হাঁটছেন, শহরজুড়ে তাঁর পদধ্বনির মুখরতা। শুদ্ধ বাংলায় দরাজ কণ্ঠে কথা বলতে বলতে হেঁটে যাচ্ছেন।
জীবনে কবি আসাদ চৌধুরীর পরিচয়ের অন্ত ছিল না। আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি। সাহিত্যে তিনি গণমুখী, নান্দনিক ও রোম্যান্টিক বিন্যাস গড়েছেন। পরিচয় উঠে এসেছে প্রাজ্ঞ, আলোচক, উপস্থাপক, আবৃত্তিকার, টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের উপস্থাপক আরও কতো কি। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অংশগ্রহণও কোনো ছোট ঘটনা নয়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার কবিতায় যে দহন, যে প্রতিবাদ, পাকিস্তানি হায়েনাদের বিরুদ্ধে যে ঘৃণা- তা তার কবিতায় তিনি লিখেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে বাংলার লোকায়ত জীবন- সবই তার লেখায় স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তুলেছেন। তার লেখা ‘বারবারা বিডলারকে’ কবিতা পড়লে বোঝা যায় মুক্তিযুদ্ধে নিরীহ বাঙালি ওপর কি ভয়াবহ অত্যাচার হয়েছে। নিজের কবিতায় সেকথা লিখতে লিখতে না জানি এই মানুষটি কতবার কান্নায় ভেঙে পড়েছেন।
তাঁর কবিতার শানিত তেজ কয়েক লক্ষ বুলেটের চেয়েও শক্তিশালী। তাঁর প্রত্যেকটি কবিতার কাঠামো-বিন্যাস, ভাষার সজীবতা, উৎপ্রেক্ষা অনবদ্য। বাঙালির জন্ম জরুল মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে যত সেরা কবিতা লেখা হয়েছে, আসাদ চৌধুরীর সব কবিতাই সেই তালিকায় পড়বে বলে বিশ্বাস করি। তাঁর আরেকটি কবিতা ‘তখন সত্যি মানুষ ছিলাম’- তার কাঠামোটাই আলাদা। তিনি লিখেছেন, ‘কুকুর বেড়াল থাবা হাঁকায়/ফোঁসে সাপের ফণা/ শিং কৈ মাছ রুখে দাঁড়ায় জ্বলে বালির কণা/আগুন ছিল মুক্তি সেনার/স্বপ্ন ঢলের বন্যায়/প্রতিবাদের প্রবল ঝড়ে/কাঁপছিল সব অন্যায়।’
মুক্তিযোদ্ধা কবি তাঁর কবিতায় পশুপাখি, মাছ, বালুর কণা সবই যে যুদ্ধে শামিল হয়েছে, সেটা বোঝাতে গিয়ে যেসব উপমা-উৎপ্রেক্ষা ব্যবহার করছেন, সেটাই ফুটে উঠেছে কবিতায়। তার কবিতা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগানিয়া অনন্য সম্পদ। কবিতা যে সাহিত্যের কত বড় শক্তিশালী হাতিয়ার তা ভালো কবিতা পড়লে বোঝা যায়। চেতনা জাগানিয়া কবিতা পড়লে বোঝা যায়। ভাষা ব্যবহারের কৌশল শক্তি কতটা, সেটা নিবিষ্ট চিত্তে বোঝা সহজ হয়। কবিতার মধ্যদিয়ে ইতিহাস- দুঃসময়ের কাল পর্ব কতো মহনীয় শব্দের মাধ্যমে তুলে ধরা যায়- সেটা আসাদ চৌধুরীর কবিতায় প্রতীয়মান।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যার বিচারের জন্য ১০১ জন বাংলাদেশি কর্মী দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ওই সময় সম্ভবত প্রজন্ম একাত্তর নামে সংগঠনটি একটা পোস্টার প্রকাশ করেছিল। ‘তোমাদের যা বলার ছিল/বলছে কি তা বাংলাদেশ?’ এই দুটো লাইন ছিল সেই পোস্টারের গায়ে লেখা। কি শক্তিশালী দুটি লাইন, এরমধ্য দিয়ে যে অস্ফুট আর্তনাদ লুকানো- তা তারাই জানে একাত্তরের পাকিস্তানি বর্বরতা যাদের সামান্যও ছুঁয়েছে। এই লাইনদুটো আর পোস্টারটি যেন চেতনার গহীনে আজও গেঁথে আছে। পরে জেনেছি আসাদ চৌধুরীর ‘শহীদদের প্রতি’ কবিতা থেকে লাইন দুটি নেওয়া হয়েছিল।
সেই কবিতার লাইনগুলো ছিল- তোমাদের যা বলার ছিল/বলছে কি তা বাংলাদেশ? শেষ কথাটি সুখের ছিল? ঘৃণার ছিল? নাকি ক্রোধের, প্রতিশোধের, কোনটা ছিল? বাংলার সূর্য সন্তান যাদের হত্যা করে একেকটি পরিবারে সদস্যদের বুকে স্বজন হারানোর দগদগে ক্ষতই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়নি, দেশকে করা হয়েছিল মেধাশূন্য। পরিকল্পিত এই হত্যার পেছনে ছিল পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলী আর কার্যকর করেছে এ দেশীয় দালালরা। যাদের ফাঁসির দাবিতে জেগে উঠেছিল বাংলাদেশ। গড়ে তোলা হয়েছিল গণজাগরণ মঞ্চ। তারপরও শহীদ পরিবারগুলোর খবর কে রাখে? কেউ কি রাখে? রায়ের বাজারের একাত্তরের বধ্যভূমি দেখলে কি মনে হয় না- একদম ভেতর থেকে কথাটি লিখেছেন আসাদ চৌধুরী।
তাঁর আরেকটি কবিতায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের নারীদের চিরায়ত স্বভাব। আর তাদের ওপর হয়নার মতো ঝাঁপিয়ে পড়া পাকিস্তানি হার্মাদদের নারকীয়তা। ‘রিপোর্ট ১৯৭১’ নামে এ কবিতায় তিনি লিখেছেন- ‘প্রাচ্যের গানের মতো শোকাহত, কম্পিত, চঞ্চল/বেগবতী তটিনীর মতো স্নিগ্ধ, মনোরম/আমাদের নারীদের কথা বলি, শোনো।/এসব রহস্যময়ী রমণীরা পুরুষের কণ্ঠস্বর শুনে/বৃক্ষের আড়ালে স’রে যায়/বেড়ার ফোঁকর দিয়ে নিজের রন্ধনে/তৃপ্ত অতিথির প্রসন্ন ভোজন দেখে শুধু মুখ টিপে হাসে/প্রথম পোয়াতী লজ্জায় অনন্ত হ’য়ে/কোঁচরে ভরেন অনুজের সংগৃহীত কাঁচা আম, পেয়ারা, চালিতা সূর্য্যকেও পর্দা করে এসব রমণী/অথচ যোহরা ছিল নির্মম শিকার/সকৃতজ্ঞ লম্পটেরা/সঙ্গিনের সুতীব্র চুম্বন গেঁথে গেছে/আমি তার সুরকার তার রক্তে স্বরলিপি লিখি/মরিয়ম, যীশুর জননী নয় অবুঝ কিশোরী/গরিবের চৌমুহনী বেথেলহেম নয়/মগরেবের নামাজের শেষে মায়ে ঝিয়ে/খোদার কালামে শান্তি খুঁজেছিল,অস্ফুট গোলাপকলি লহুতে রঞ্জিত হ’লে/কার কী বা আসে যায়।’
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ দুলক্ষ মা-বোনদের সম্ভ্রম লুণ্ঠনের কাহিনী আর কতো বলা যায়? একজন কবি কতটা বেদনা নিয়ে এই ইতিহাস লিখেছেন, কব্যের ধারাকে অক্ষুণ্ণ রেখে। এই ইতিহাসের কথাকার, গণযুদ্ধের জনযোদ্ধা কবি আসাদ চৌধুরীর সব কবিতাই হৃদয়ের গহীন থেকে উৎসারিত। প্রাণবান চিরতরুণ এই কবি। কবি আসাদ চৌধুরী কয়েক বছর ধরে পরিবার নিয়ে টরন্টোতে বসবাস করছিলেন। তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে থাকেন অটোয়ায়। মাসখানেক আগে কবি আসাদ চৌধুরীর এনজিওগ্রাম করে দুটি ব্লকের ৯৯ ও ৮৮ শতাংশ সারানো হয়। এরপর তিনি বাসায় ছিলেন। হঠাৎ তার শরীর খারাপ করলে কানাডার ওসোয়ার হাসপাতালটিতে তাকে ভর্তি করা হয়। ফুসফুস ও হার্ট দুটিরই খুব জটিল অবস্থা ছিল কিন্তু তারপরে? বুধবার স্থানীয় সময় দিবাগত রাত ৩টায় কানাডার টরন্টোর আসোয়া শহরের লেকরিচ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার স্থানীয় সময় দিবাগত রাত ৩টায় কানাডার টরন্টোর আসোয়া শহরের লেকরিচ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি লোকান্তরিত হন।
বাংলাদেশে এ খবর আসার পরে শোকে যেন মূষরে ওঠে গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। তাঁর কবিতা ‘সত্য ফেরারী’র মতো বলতে ইচ্ছে করে- কোথায় পালাল সত্য? দুধের বোতলে, ভাতের হাঁড়িতে! নেই তো? রেস্টুরেন্টে, হোটেলে, সেলুনে, গ্রন্থাগারের গভীর গন্ধে, টেলিভিশনে বা সিনেমা, বেতারে, নৌকার খোলে, সাপের ঝাঁপিতে নেই তো।’ মানুষ তাকে অতিক্রম করে তার কাজ দিয়ে। মানুষ মারা যাবে এটাই সত্য। কিন্তু বেঁচে থাকে তার কাজের মধ্যদিয়ে। সেদিক থেকে আসাদ ভাইকে ভুলবে না কেউ। দুহাতে লিখেছেন তিনি বহুমাত্রিক লেখা। তাকে ভোলার নয়। তিনি বেঁচে থাকবেন তার সৃষ্টির মধ্যে।
: দীপংকর গৌতম
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক।
Posted ১০:২৪ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৩
banglapostbd.news | Rubel Mia
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের বিধি মোতাবেক নিবন্ধনের জন্য আবেদিত
৭৮/৩ কাকরাইল, ভিআইপি রোড, ঢাকা-১০০০।